‘মাছে ভাতে বাঙালি’—এই প্রবাদটি যার কথা ছাড়া অসম্পূর্ণ থেকে যায়, সে হলো ইলিশ। স্বাদে, গন্ধে আর রূপে অতুলনীয় এই মাছটি কেবল বাঙালির খাদ্য তালিকাতেই নয়, বরং সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের গভীরে মিশে আছে। এ কারণেই ইলিশকে বলা হয় ‘মাছের রাজা’ এবং এটি আমাদের জাতীয় মাছের গৌরবে সম্মানিত।

ইলিশ একটি সামুদ্রিক মাছ, তবে এর জীবনচক্র বড়ই বিচিত্র। বঙ্গোপসাগরের নোনা জলে এদের বাস হলেও প্রজনন মৌসুম বা ডিম ছাড়ার সময় এরা ঝাঁক বেঁধে নদীর মিষ্টি জলে চলে আসে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও এদের শাখা নদীগুলোই ইলিশের প্রধান প্রজননক্ষেত্র। নদীর উজানে সাঁতার কাটার এই কঠিন যাত্রাপথেই ইলিশের শরীর হয়ে ওঠে চর্বিযুক্ত এবং এর স্বাদ বহুগুণে বেড়ে যায়। একারণেই নদীর ইলিশ, বিশেষ করে পদ্মার ইলিশের কদর বিশ্বজুড়ে। এর উজ্জ্বল রূপালি শরীর, मोहনীয় গন্ধ আর তুলনাহীন স্বাদ একে অন্য সব মাছ থেকে আলাদা করেছে।
বাঙালির রান্নাঘরে ইলিশের কদর যেন এক শিল্প। ইলিশ ভাজা, সর্ষে ইলিশ, ভাপা ইলিশ, ইলিশ পাতুরি, ইলিশ পোলাও, দই ইলিশ কিংবা ইলিশের ডিম—এরকম অসংখ্য জিভে জল আনা পদের তালিকা শেষ হওয়ার নয়। নববর্ষের প্রথম দিন পান্তা-ইলিশ ছাড়া যেন বাঙালির উৎসবই জমে না। এটি এখন আমাদের বর্ষবরণের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। শুধু উৎসবে নয়, সাধারণ দিনেও এক টুকরো ভাজা ইলিশ আর গরম ভাত পেলে বাঙালির মন খুশিতে ভরে ওঠে।
ইলিশ মাছ বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের একটি বড় অংশ আসে ইলিশ থেকে। লক্ষ লক্ষ জেলে ও মৎস্যজীবী এই মাছ আহরণ, পরিবহন এবং বিক্রির সাথে জড়িত থেকে তাদের জীবিকা নির্বাহ করেন। দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইলিশ বিদেশেও রপ্তানি হয়, যা আমাদের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে আসে। ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের ইলিশের ব্র্যান্ডিং আরও শক্তিশালী হয়েছে।
তবে এই অমূল্য সম্পদ আজ নানা কারণে হুমকির মুখে। অতিরিক্ত আহরণ, নিষিদ্ধ কারেন্ট জালের ব্যবহার এবং প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ ও ছোট ইলিশ বা জাটকা নিধনের ফলে এর প্রাপ্যতা কমে যাচ্ছিল। সৌভাগ্যবশত, বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ইলিশ রক্ষায় নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রজনন মৌসুমে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করা এবং জাটকা সংরক্ষণে কঠোর আইন প্রয়োগের ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইলিশের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ইলিশ শুধু একটি মাছ নয়, এটি বাঙালির আবেগ ও পরিচয়ের প্রতীক। এর স্বাদ আমাদের রসনাকে তৃপ্ত করে, এর রূপ আমাদের চোখকে মুগ্ধ করে আর এর সাথে জড়িয়ে থাকা ঐতিহ্য আমাদের গর্বিত করে। এই জাতীয় সম্পদকে রক্ষা করা আমাদের সকলের দায়িত্ব, যাতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাঙালি এই মাছের রাজার স্বাদ আস্বাদন করতে পারে।
Hi, this is a comment.
To get started with moderating, editing, and deleting comments, please visit the Comments screen in the dashboard.
Commenter avatars come from Gravatar.